জায়োনিস্টরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর জন্যে নেগেভ মরুভূমিতে গোপন পারমাণবিক "গবেষণা" কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, নিকটবর্তী ছোট শহর ডিমোনার নামে এটিকে ডিমোনা কেন্দ্রও বলা হতো। সম্পূর্ণ কর্মসূচী ছিল কঠোরভাবে গোপনীয়তায় ঢাকা।

ফ্রান্সের সাথে গোপন সমঝোতার সুবাদে এই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর প্রকল্প শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এমনকি তাদের স্থায়ী মিত্র আমেরিকার কাছেও ব্যাপারটি গোপন রাখা হয়। ষাটের দশকের শুরুতে আমেরিকার গোয়েন্দারা সন্দেহ করতে শুরু করেন, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) এর পরিদর্শনের দাবী উঠে; কিন্তু ইসরায়েল আইএইএ এর প্রতি পাল্টা শর্ত আরোপ করে যে পরিদর্শক দলের সবাই শুধু মাত্র আমেরিকার নাগরিক হতে হবে, এবং আইএইএ নয়, আমেরিকা এই পরিদর্শন কাজটি করবে। এই শর্ত মেনে নেয়া হয়। কিন্তু, ইসরায়েল এই পরিদর্শনের ক্ষেত্রে আমেরিকার সাথেও বছরের পর বছর প্রতারণা করেছে।

এতোসব গোপনীয়তার মধ্যে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে ফাঁস হওয়া তথ্য হতে ধারণা করা হয়, আশির দশকেই তারা প্রায় দেড়শত পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে, ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতি হলো, তারা পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করবে না, অস্বীকারও করবে না। 

এতো গোপনীয়তা সত্বেও, এসংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ ফাঁস হয়।

মরক্কোয় অর্থোডক্স ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয়া মরদেকাই ভানুনু পরিবারের সাথে অভিবাসী হয়ে ইসরায়েলে এসেছিলেন। একপর্যায়ে উনি ডিমোনা পারমানবিক গবেষণা কেন্দ্রে চাকুরিতে ঢোকেন। নয় বছরের মতো চাকুরি করেন, পরে বাজেট সঙ্কোচনের ফলে ছাঁটাই হন।

ভানুনু অনেক বছর ধরেই মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন, তার মানসিক অস্থিরতার কারণ ছিল, আরবদের প্রতি ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উগ্র ডানপন্থী থেকে মধ্যপন্থি রাজনৈতিক চিন্তায় সরে আসেন। ইসরায়েলের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতি তার সমালোচনা তৈরী হচ্ছিল। ১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধের উনি তীব্র বিরোধী ছিলেন; কিন্তু রিজার্ভ সৈন্য হিসেবে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের হয়ে যুদ্ধে যেতে হয়। সেখানে যে নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন, তা মনে স্থায়ী দাগ কাটে। এক পর্যায়ে ভানুনু গোপনে ইসরায়েল কম্যিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। 

ভানুনু
ডিমোনায় চাকুরি শেষে উনি বিশ্ব ভ্রমনে বের হন, বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় আফিমসহ অন্যান্য মাদক গ্রহনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। শুরু করেছিলেন গ্রীস দিয়ে; থাইল্যান্ড, নেপাল, বার্মাসহ বিভিন্ন দেশ হয়ে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছান। সেখানে একাকীত্ব কাটাতে ট্যাক্সি চালানো শুরু করেন, এবং এক পর্যায়ে ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহন করেন।

ধর্মান্তরিত হয়ে কিছুটা প্রশান্তি ছোঁয়া পেলেও, দায়বদ্ধতা যেনো আরো বড় হয়ে ওঠে; উনি সিদ্ধান্ত নেন, ইসরায়েলের গোপন পারমানবিক অস্ত্র কর্মসূচীর তথ্য প্রকাশ করে দিবেন। নয় বছর ডিমোনা কেন্দ্রে কাজ করেছেন, শেষের দিকে ঐ অতি গোপনীয় স্থাপনায় ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে দুই রীল ছবি তুলেও রেখেছেন। সব প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইংল্যান্ডের সানডে টাইমস পত্রিকার সাথে তার যোগাযোগ হয়, সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রকাশের আগে ভানুনুর বক্তব্য যাচাই করার জন্যে সানডে টাইমস বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়, এইসব দীর্ঘসূত্রিতায় ভানুনু অস্থির হয়ে পড়েন। উনি আশংকা করছিলেন, মোসাদ তার পীছু নিয়েছে। নিজের এই আশংকা সত্বেও, সানডে টাইমসের পেশাদারি সতর্কতা সত্বেও, ভানুনু ঠিকই মোসাদের হানিট্র্যাপে ধরা পড়ে যান।

মোসাদের লেলিয়ে দেয়া ইহুদি নারী "আমেরিকান ট্যুরিস্ট" পরিচয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে, ঘনিষ্টতার সুযোগে তাকে অপহরণ করে ইতালি হয়ে ইসরায়েল নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে দেশদ্রোহীতা ও অন্যান্য দায়ে তার শাস্তি হয়। ১৮ বছর জেল খাটেন, এর মধ্যে এগারো বছর সলিটারি কনফাইনমেন্ট (নির্জন কারাবাস); ২০০৪ সালে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পান। বিদেশী সাংবাদিকের সাথে কথা বলার অপরাধে আবার ২০১০ সালে আটক হন।

ভানুনু এবং সানডে টাইমস কর্তৃপক্ষের আশা ছিল, ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী ফাঁস হলে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরী হবে, ঐ কর্মসূচি পন্ড হবে, আরো অন্যান্য সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েল বাধ্য হবে।

হায়! এসবের প্রায় কিছুই ঘটে নাই!

তার দেখানো পথ ধরে, জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জদের উইকিলিকস আমেরিকার বিভিন্ন গোপন নথি ফাঁস করেছিল; আশা হয়ত ছিল, চাপ তৈরী হবে, দানবটি কিছুটা হলেও সংযত হবে। না, যা অনুমিত ছিল, তার প্রমাণ লোকের হাতে এসেছে - অর্জন এটুকুই। দানবটাকে শাসনে আনা যায় নি!