গত ৪,০০০ বছর ধইরা পুরুষতন্ত্র একজন নারী কতদূর কাপড় পরবেন বা খুলবেন তার হিসাব কইরা আসছে। সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের প্রধান খুঁটি পুরুষতন্ত্রের অন্যতম কাজ ছিলো নারীর দুইখান উপযোগিতা তৈরি করা, (১) শুধুমাত্র একজন পুরুষের গর্ভে গণ্ডাখানেক সন্তান উৎপাদন কইরা সেই সন্তানরে পুরুষের সম্পত্তি এবং পুরুষতন্ত্রের চাকর এবং পুঁজিবাদের শ্রমিক হিসাবে তৈরি করা, এবং (২) পুরুষের যৌন এবং নৈতিক সম্পত্তি হিসাবে বহাল রাখা। এই দুই উপযোগিতা তৈরি করতে নারীর চরিত্র এবং নারীর পোশাক অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

পরবর্তীতে যখন আঠারশ’ সতকের শেষ দিকে আমেরিকা, ইয়োরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ায় নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তখন নারীবাদীদের সকল নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের পাশাপাশি নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার আদায়ের আন্দোলন দেখা যায়। যদিও ১৯৬০ সালের আগে তা প্রকট আকারে শুরু হয় না। এইসময় নারীবাদীরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ ঘোষনা শুরু করেন, উনারা বলেন, পুঁজিবাদই একজন নারীরে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তর করে। সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতা বা বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন প্রশ্নের সামনে চইলা আসে।

পুঁজিবাদ এবং সেই সূত্রে পুরুষতন্ত্র নারীরে ভোগ্যপণ্য হিসাবে ব্যবহার করছে সত্য। পর্নোগ্রাফি থিকা শুরু কইরা সাধারণ টেলিভিশান বিজ্ঞাপন সহ মার্কেটিং এর প্রতিটা ক্ষেত্রে নারী ব্যবহৃত হইছেন। কিন্তু মজার বিষয় হইতেছে, সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদ যেই সময় শুরু হইছে, সেই সময়ের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আজকের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থিকা প্রকটভাবে আলাদা হইয়া গেছে। আজকে আর পৃথিবী শুধুমাত্র লগ্নিপুঁজির পৃথিবী না, ফিনান্স ক্যাপিটাল এবং সেই সূত্রে রোবোটিক্স, জি-এম-ও, জেনেটিক্সের উত্থান শ্রমিকের সংজ্ঞা এবং সেই সূত্রে নারীর পণ্যায়নের সংজ্ঞা ভীষনভাবে পাল্টায় ফেলছে। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভে আটকাইয়া থাকা নারীবাদীরা, বিশেষতঃ বাংলাদেশের অর্ধেক পড়ালেখা করা নারীবাদীরা সেকেন্ড ওয়েভ থিকা বাইর হইতে পারতেছেন না।

উনারা পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে খাড়াইতে গিয়া নিজেরা আরেকটা পুরুষতন্ত্র চালু করতেছেন এইটা বুঝতে পারতেছেন না। এইখানে খেয়াল রাখা জরুরী, নারীবাদ কোনো সমাজবিচ্ছিন্ন এজেন্ডা না। সমাজের সাথে তাল দিয়াই নারীবাদরে আগাইতে হবে। ২০১৯ সালে বইসা ১৯৬০ সালের মত কইরা চিন্তা করা বা অর্থনীতি, বিশ্ব রাজনীতি বাদ দিয়া প্যারোকিয়ালিজম আক্রান্ত হইয়া শুধুমাত্র এথনোসেন্ট্রিক চিন্তা নিয়া নারীবাদরে কোথাও নিয়া যাওয়া সম্ভব হবে না।

এখন আসেন বেসিক জায়গা থিকা শুরু করি। নারী কাপড় খুললে কে বেশি খুশী হয়? লিঙ্গ বিচারে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বিচারে পুরুষতন্ত্র। নারী কাপড় পরলে কে বেশি দুঃখিত হয়? লিঙ্গ বিচারে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বিচারে পুঁজিবাদ। তাইলে কী দাঁড়াইলো, নারী কি কাপড় পরাই বাদ দিয়া বা কাপড় নিয়াই সারাদিন চিন্তা কইরা চান্দে যাবেন গিয়া?

না।

তবে নারীদের বুঝতে হবে কাপড় অর্থাৎ পোশাকের রাজনীতি কী। কিন্তু তার আগে এখন আসেন ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক রুচি আধুনিক নারীবাদের অন্যতম অনুষঙ্গ অবশ্যই। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা যেন সামাজিক মূল্যবোধরে আহত না করে তা খেয়াল রাখাও সামাজিক মানুষের কর্তব্য। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ কী বিষয় দিয়া নির্ধারিত হয় বলেন। নোম্যাড মানুষরা লিঙ্গ নির্বিশেষে ট্রাউযার্স বা প্যান্টসের মত পোশাক পরলেও উনিশশ’ শতকে আইন কইরা মেয়েদের ট্রাউযার্স বা প্যান্টস পরা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৫২ সালে হ্যারিয়েট ফ্রেঞ্চ বইলা একজন নারী ট্রাউযার্স পরার ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হন। তিনি কি নারী হইয়া ‘পুরুষের পোশাক’ পইরা সামাজিক মূল্যবোধরে আহত করেন নাই? নিশ্চই করছেন। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ যদি প্রতিনিয়ত লিঙ্গ বৈষম্য কইরা অভ্যস্ত থাকে, সেইক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধরে আহত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

এইটা নারীবাদের ‘এ্যাকটিভিজম’ অংশ। এ্যাকটিভিজমের বিপক্ষে প্রচুর কথা আছে, কিন্তু নারীবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ্যাকটিভিজম পাবলিক প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ কইরা সামাজিক মূল্যবোধরে ঝালাই করার চিন্তা করায় বইলা সমাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

এখন আসেন, আবার বেসিক প্রশ্নে ফেরত যাই। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থিকা একজন নারী কতদূর পোশাক পরবেন?

আমাদের অর্ধেক পড়ালেখা কইরা সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদে আটকায় থাকা বাংলাদেশী নারীবাদীরা ভাবেন, জামার গলা দুই ইঞ্চি নিচে নাইমা যদি ক্লিভেজ দেখা যায় বা শাড়ির তলা দিয়া নাভি বোঝা যায়, তাইলেই তা নারীবাদ পরিপন্থী কারণ তা প্রকারান্তরে পুরুষতন্ত্ররে পরিচর্যা করে। যেহেতু শরীরের অংশ বাইর হইলেই পুরুষ কামুক হইয়া পড়েন, সুতরাং যেই নারী শরীর বাইর করলেন, সেই নারী নিজেরেই নিজে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তর করলেন। ঠিক এর উল্টাভাবে সেকেন্ড ওয়েভে আটকায় থাকা আরেক গোষ্ঠি নারীবাদী ভাবেন, যেহেতু নারীদের পোশাক নিয়া এত অবদমন হইছে, সুতরাং সব খুইলা ফেললেই নারীবাদ প্রতিষ্ঠা পায়।

হিহি।

এত ছাগলস চারিদিকে!

শোনেন, ছাগলস আপাস এ্যান্ড ভাইয়াস, পোশাক একজন সামাজিক মানুষের অনুষঙ্গ, এর বাইরে আর কিছু না। অন্যান্য আরো বিভিন্ন কারণ ছাড়াও এইপসদের মধ্যে মানুষ দুই পায়ে সোজা হইয়া খাড়ান বইলা মানুষরে ডিসেক্সুয়ালাইজেশান করতে হয় বইলা প্রাচীন মানুষ পোশাক পরা শুরু করছিলেন। কিন্তু ডিসেক্সুয়ালাইজেশান একটা ভেইগ টার্ম। কারণ মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা অন্য মানুষের পায়ের পাতা বা চোখের পাপড়ি দেইখা যৌন উত্তেজনা বোধ করতে পারেন। কোনো বান্দর অন্য বান্দরের হাতে লাগানো মেন্দি দেইখা যৌন উত্তেজনা অনুভব করেন না। কোনো ছাগল অন্য ছাগলের বেণী বান্ধা ল্যাঞ্জা দেইখা যৌন উত্তেজনা অনুভব করেন না। সেই কারণেই যৌন উত্তেজনা ঠেকানোর জন্য পৃথিবীর প্রতিটা ধর্ম নারীদের আরবে কালো বস্তা এবং ইয়োরোপে ষোলোটা পেটিকোট পরায়ে রাখার চেষ্টা করছে।

এই সিস্টেমের প্রায় দেড় হাজার বছর পরে নারীবাদীরা বলা শুরু করছেন, একজন পুরুষের যৌন উত্তেজনার ‘সম্পূর্ণ’ দায় যেহেতু নারীর নাই, সুতরাং পুরুষরা নিজেদের উত্তেজনা দমন করতে শিখুক, এবং আমরাও নিজ স্বাচ্ছন্দ্যে কাপড় পরা শুরু করি। এই বাক্যের উপর ভিত্তি কইরা মেয়েরা নিজেদের জামার দৈর্ঘ্য পাল্টাইছেন পরবর্তী ১০০ বছরে। প্রশ্ন আসতে পারে, এতে কি পুঁজিবাদ লাভবান হয় নাই? নিশ্চই হইছে। কারণ পুঁজিবাদ তো আর ছাগলতন্ত্রের উপর ভিত্তি কইরা নির্মিত অবস্থান না যে তারা রিফর্মড হবে না। মজার বিষয় হইলো, বর্তমানে পুঁজিবাদ যেই জায়গায় আছে, তাতে আপনি যেই দিকে হেলবেন, পুঁজিবাদও আপনার সাথে সেই দিকে হেলবে। এইটাই পুঁজিবাদের গত ৪,০০০ বছরে টিকা থাকার স্ট্র্যাটেজি। সেইক্ষেত্রে আবারও যদি বেসিক আলোচনায় ফেরত যাই, অর্থাৎ একজন নারী কতদূর কাপড় পরবেন বইলা প্রশ্ন করি, তাইলে জিগাইতে হবে, একজন নারী কি বর্তমান সামাজিক মূল্যবোধ এবং সেই সূত্রে পুঁজিবাদরে আরো ৪,০০০ বছর টিকাইয়া রাখার বাসনায় সমাজে প্রচলিত পোশাকের সাথে তাল মিলাবেন, নাকি নিজ পোশাকের মাধ্যমে পুঁজিবাদ এবং সেই সূত্রে সামাজিক মূল্যবোধরে নিজ আদর্শের সাথে অনুরণন করাইয়া তারে রিফর্ম করাইতে বাধ্য করাবেন?

আমার উত্তর হচ্ছে, আমি দ্বিতীয় রাস্তায় যাবো। আজকের ফিনান্স ক্যাপিটালের যুগে আমি প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের ঠিক কইরা দেওয়া পোশাক পরবো না অবশ্যই, কিন্তু তার অর্থ এই না যে আমি আমার সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণ ভুইলা গিয়া সম্পূর্ণ কাপড় খোলার স্বেচ্ছাচার চালাবো। এইক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কেউ যদি সম্পূর্ণ বা আংশিক কাপড় খোলারে তার এ্যাকটিভিজমের অংশ বইলা বিশ্বাস করেন, তারেও সাপোর্ট জানাইতে আমার দ্বিধা নাই। কেউ যদি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় নিজেরে পণ্যে রূপান্তর করেন, তাতেও আমার আপত্তি নাই। পুঁজিবাদের জন্ম থিকাই প্রতিটা মানুষ পণ্য, কেউ মেধা বেইচা, কেউ বুদ্ধি বেইচা, কেউ শ্রম বেইচা পণ্য। সুতরাং আজকের দিনে ব্র্যাড পিট বা জর্জ ক্লুনি বা সালমান রুশদি বা স্টিফেন হকিং যদি নিজেদের শরীর, মেধা এবং জ্ঞান বেইচা প্রতিষ্ঠা পাইতে পারেন, একজন এঞ্জেলিনা জোলি, একজন ম্যাডোনা, একজন লেডি গাগা, একজন অরন্ধতি রায়, একজন অপরাহ উইনফ্রে, একজন এলেন ডিজেনেরাস, একজন জয়া আহসান, একজন মিশেল ওবামা নিজের শরীর, মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি সবই বেচতে পারেন। প্রয়োজনে কাপড় পরতে এবং প্রয়োজনে কাপড় খুলতে পারেন; এবং এরপরেও নিজেদের নারীবাদী বইলা ঘোষনা দিতে পারেন।

কারণ কাপড়ের দৈর্ঘ্য দিয়া নারীর চরিত্র এবং মনস্তত্ব বিচার করার দিন শেষ। নারী এখন স্বেচ্ছায় কাপড় পরেন এবং স্বেচ্ছায় কাপড় খোলেন। সেই পরাপরি এবং খোলাখুলিতে যদি পুরুষ যৌন উত্তেজনা বোধ করেন বা এমনকি পুঁজিবাদ লাভবানও হয়, তাইলেও তা নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী হয় না। কারণ নারীবাদ নারীর স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করে। যদিও পুঁজিবাদের দুনিয়ায় মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বইলা কোনো ইচ্ছা নাই, তথাপি, নারীবাদ যেহেতু লিঙ্গ নির্বিশেষে ব্যক্তির ‘তথাকথিত’ স্বাধীন মনস্তত্বরে গুরুত্ব দেয়, সেই কারণে নারীবাদ একজন নারীরে দিয়া জোর কইরা বোরখা বা হিজাব পরায় না এবং তা খোলায়ও না। একজন নারী যদি স্বেচ্ছায় হিজাব বা শাঁখা-সিঁদুর পরেন, তা যেমন পুরুষতন্ত্ররে সার্ভ করলেও তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা, তেমনি, একজন নারী যদি স্বেচ্ছায় শরীর বেচেন বা নিজের শরীররে ভোগ্যপণ্যেও পরিণত করেন বা কাপড় খুইলা ন্যাংটা হইয়া হাঁটেন, সেইটা পুঁজিবাদরে সার্ভ করলেও সেইটাও তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা।

সুতরাং ডিয়ার ছাগল নারীবাদী আপারা, আপনাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা আপনাদের কুয়া থিকা বাইর হইয়া সমুদ্রের দিকে তাকান। দেখেন, আপনাদের ক্ষুদ্র চিন্তার বাইরেও পৃথিবী অনেক বড়। আর দয়া কইরা আপনারা নিজেদের নারীবাদী ডাইকা অন্যের পোশাক দিয়া তার চরিত্র বিশ্লেষণ কইরা নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক প্রাণিতে রূপান্তর করা বন্ধ করেন। সত্যি কথা বলতে কী, আপনাদের দেখলে আমার হাসি পায়, দুঃখও হয়। মনে হয়, আজকের দুনিয়ায় মেয়েরা এইসব বালছাল টপিকরে গোনায় না ধইরা চান্দে চইলা যাইতেছেন, আর আপনারা পুরুষতন্ত্রের পাশে বইসা বইসা কোন্‌ মেয়ের বুকের উপর থিকা দুই ইঞ্চি ওড়না সরছে আর উনারে বেশ্যা বানাইয়া পুরুষতন্ত্রের চাকর প্রমাণ করতে ব্যস্ত হইছেন। অথচ, আপনারা নিজেরাই যে পুরুষতন্ত্রের চাকর, তা আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারতেছেন না!

নাদিয়া ইসলাম : নারীবাদী লেখক