নাদিয়া ইসলাম: নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট
নাদিয়া ইসলাম
ফেইসবুকে বইসা আমি ক্যানো নারীবাদ নিয়া কচকচাই তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরী। আমার পড়ালেখা এবং গবেষণার বিষয় ফরেনসিক জেনেটিক্স, নারীবাদের ‘ন’ আমি কোনোদিন ইস্কুল থিকা পইড়া আসি নাই। মাত্র তিন বছর আগে তনু হত্যাকাণ্ডের সময় বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নির্লজ্জ ডাহা মিথ্যাচার দেইখা আমি প্রথম বুঝতে পারি এই অঞ্চলের মানুষের জেনেটিক্স, অপরাধ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রীয় আইন বা নারীবাদ কোনোকিছু নিয়াই বিন্দুমাত্র পড়ালেখা নাই। যাদের পড়ালেখা আছে, উনারা ক্ষমতার হায়ারার্কিতে এত উচ্চ অবস্থানে বইসা বইসা দেশের মানুষের পয়সায় ফূর্তি কইরা সুশীলতা চর্চা করেন যে উনাদের ঠেকা পড়ে নাই বাদবাকি ১৬ দশমিক ৯৯৯৯৯৯৯৯৯ কোটি জনগোষ্ঠীর ভুল ভাঙ্গাইতে যাবেন। (বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি হিসাব কইরা কথা বলতেছি।)

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন লিঙ্গ হিসাবে পুরুষ উচ্চ শ্রেণির। দুই দিন আগে পাপিয়া জেরীন নামের একজন নারী- পুরুষ কত সুপিরিয়র এই নিয়া ফেইসবুকে বাকবাকুম করা শুরু করছেন। তা পাপিয়া জেরীন একলা না। বাংলাদেশের ১৬ দশমিক ৯৯৯৯৯৯৯৯৮ কোটি মানুষ বিশ্বাস করেন লিঙ্গ বিচারে পুরুষ নারীর চাইতে উচ্চ অবস্থানে আছেন। এবং এই বিশ্বাসের কারণ হিসাবে উনারা পুরুষ আকারে কত বড়, পুরুষ কত ভার বহন করতে পারেন, পুরুষ কত বেশি দৌড়াইতে পারেন, পৃথিবীতে কত পুরুষ দার্শনিক, গবেষক, লেখক, অংকবিদ, শিল্পী আছেন এই নিয়া নিয়মিত হাস্যকর সব বাণী প্রসবাইতে থাকেন। মাথায় মাল কম হইলে প্রশ্রাবের বেগ বেশি হয় কিনা আমার জানা নাই। তবে পৃথিবীর সমাজবিজ্ঞানীরা এই নিয়া গবেষণা করতে পারেন কিনা ভাইবা দেখবেন। ফুড ফর থট দিয়া গেলাম।

না, আমারে ভুল বুঝবেন না। আমি নারী বড় না পুরুষ বড় এই নিয়া আন্দোলন করতে নামি নাই। আমি আমার জীবনের পুরুষদের ভালোবাসি, আমি বিশ্বাস করি, মাথায় মাল থাকা এবং কম প্রশ্রাব করা নারী পুরুষ ট্রান্সজেন্ডার সকল মানুষ মিলাই এই পৃথিবী তৈরি করছেন। কিন্তু পাপিয়া শ্রেণির কেউ যখন নারীর চাইতে পুরুষ বড় এমন গল্প দিতে আসেন, তাদের আমি বিজ্ঞান এবং পৃথিবীর ইতিহাস পইড়া আসার পরামর্শ দেই। আমার এই আচরণরে অনেকে ধৃষ্টতা এবং জ্ঞানের অহংকার বইলা বিশেষায়িত করেন, এবং উনাদের বিশেষনে ভুল ধরতে আমার কোনোপ্রকার আগ্রহ হয় না। কারণ আমি যে উনাদের থিকা দুই লাইন বেশি জানি এই সত্য প্রকাশ করতে আমার যদি অহংকার দেখাইতে হয়, আমি এক কোটি সাতাত্তর হাজারবার সেই অহংকার দেখাবো।

যারা হিউম্যান জিনোম নিয়া দুই লাইন পড়ালেখা করছেন, এবং সেই পড়ালেখা যদি গুগোল ভিত্তিক পড়ালেখাও হয়, তাইলে জাইনা থাকবেন, জেনেটিক্সের হিসাবে বা প্রকৃতিপ্রদত্তভাবে একজন নারী স্বয়ংসম্পূর্ণ। আপনি পুরুষই হন আর নারীই হন, আপনার শরীরের অন্যতম প্রধান ডিএনএ হইলো মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ। এই ডিএনএর নাম মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ তার কারণ এই ডিএনএ আপনি আপনার মায়ের থিকা পাইছেন। দুনিয়াতে ফাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ অর্থাৎ একান্তভাবে বাপের কাছ থিকা ডিএনএর কোনো অস্তিত্ব নাই কারণ একজন বাপ একান্তভাবে কোনো ডিএনএ আপনারে সাপ্লাই দেন না। আপনি পুরুষ হইয়া থাকলে আপনার বাপের সূত্রে একটা মাত্র ওয়াই ক্রোমোযোমের উত্তরাধিকারী হবেন, কিন্তু সেই ওয়াই ক্রোমোযোম ছাড়াও পৃথিবীরে টিকায়ে রাখা সম্ভব। মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ ছাড়া তা সম্ভব না। সুতরাং দ্বিতীয়বার যখন নারী বড় না পুরুষ বড় এই নিয়া আপনারা লাফাইতে যাবেন, তখন এই তথ্য স্মরণ করবেন আশা করি।

এখন আসেন, পুরুষের শারিরীক আকার বড় ক্যানো এই নিয়া আলাপ দেওয়া যাক। পুরুষের শারিরীক আকার (বেশিরভাগক্ষেত্রে) নারীর চাইতে বড়, তার কারণ বিবর্তন, পুঁজিবাদ এবং লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব। মাত্র ১২ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে যখন এগ্রিকালচারাল রেভোলুশান শুরু হয়, তখন মানুষ টিকা থাকার স্বার্থে প্রথম শ্রমিকের উপযোগিতা নিয়া গবেষণা শুরু করেন। উনারা আবিষ্কার করেন, একজন পুরুষ যদি জমিতে লাঙ্গল দেন এবং একজন নারী যদি গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা জন্ম দিয়া লাঙ্গল দেওয়ার মত শ্রমিক তৈরি করতে পারেন, তাইলে সবচাইতে বেশি ফসল উদ্বৃত্ত থাকে। এবং শ্রমিক তৈরির স্বার্থেই পুরুষরে আকারে বড় হইতে হইছে। এইটা একদিনে হইয়া যায় নাই, এই ঘটনা ঘটতে কয়েক হাজার বছর সময় লাগছে।

মজার বিষয় হইতেছে, পুরুষতন্ত্রের প্রথম শিকার যে পুরুষ, তাই পুরুষরা জানেন না। পুরুষতন্ত্র নারীরে অবদমন করছে সত্য, কিন্তু পুরুষতন্ত্র নিজেরে টিকাইয়া রাখতে তার প্রথম ভারবাহী গাধা বানাইছে পুরুষরেই। ধরেন, আমি একজন সাধারণ নারী। ধরেন, নারীবাদ নিয়া আমার মোটেই পড়ালেখা নাই। এখন চিন্তা কইরা দেখেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন নারী হিসাবে আমারে কি খুব কষ্ট করতে হয়? আমার বাপ এবং স্বামীর কান্ধে চইড়া আমি সারাজীবন ফূর্তিতে দিন কাটাইতে পারি। হয়তো আমারে তিন চাইর খানেক বাচ্চা পয়দা করতে হবে, তা নাহয় করলাম, নাহয় বাপ আর স্বামীর জন্য দুইবেলা রান্দলাম, তাতে কি আমার বিশেষ সমস্যা হইতেছে? হয় না তো! স্বামী সাহেবরেই সারাদিন খাইটা খুইটা পয়সা আয় কইরা আমারে সোনার গয়না আর বেনারসি শাড়ি কিনা দিতে হইতেছে! সেই স্বামী যদি বেকার হইয়া যান, সেই স্বামী যদি আর পয়সা উপার্জন করতে না পারেন, সেইক্ষেত্রে সমাজ স্বামী সাহেবরেই অথর্ব হিসাবে দেখবে, আমারে বলবে না, ‘স্বামী পারতেছেন না তাই আপনি যান ইট ভাঙ্গতে!’

(এইক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যারা স্বেচ্ছায় ঘরের কাজ করেন বা ঘরের কাজ করতে বাধ্য হন, তাদের কাজ খুব সহজ বা মূল্যহীন, এমন কোনো কথা আমার আলাপের বিষয় না। রওশন আরা মুক্তার কমেন্টের বিপরীতে এইটুক এডিট দিলাম।)

সেই কারণে পাপিয়ার মত কতিপয় সুবিধাভোগী এবং স্বার্থপর নারীরে আপনারা দেইখা থাকবেন পুরুষের কান্ধে ঠ্যাং দিয়া বইসা পুরুষতান্ত্রিকতার পক্ষে সুরেলা গলায় মিষ্টি মিষ্টি গান গাইতে।

পুরুষের কান্ধে চইড়া খাওয়া এইসকল নারীরা জানেন না, নারীবাদের প্রধান আলাপই হইলো নারী পুরুষের সম অধিকার আন্দোলনের আলাপ। তাই উনারা নারীবাদের আলাপ উঠলে ভয় পান এই ভাইবা যে উনাদের ফূর্তির দিন কি তবে শেষ হইতে চললো? উনাদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, কারণ নারীবাদ পুরুষরে আর একলা ভারবাহী গাধা হিসাবে দেখতে চায় না, নারীবাদ নারীরেও গতর খাটাইয়া কাজ করার এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার কথা বলে। কিন্তু এই স্বাধীনতার অর্থ এই না যে নারী ক্ষমতার মাথায় চইড়া বইসা পুরুষতন্ত্র এতদিন ধইরা নারীর উপর যেই নির্যাতন নিষ্পেষন নিপীড়ন চালাইছে, তাই আবার পুরুষের উপর শুরু করবে। এইক্ষেত্রে খেয়াল রাখা জরুরী যে, নারীবাদ পুরুষরে হঠাইয়া নারীরে ক্ষমতায় বসাইতে চায় না বা নারী আধিপত্যও বিস্তার করতে চায় না। নারীবাদ বলে পুরুষতান্ত্রিকতা এবং সেই সূত্রে পুঁজিবাদ মানুষরে যেই সিস্টেমের অধীন শ্রমিক বানাইছে, সেই সিস্টেম থিকা মানুষের মুক্তি হোক। একজন পুরুষের উপর অর্থ আয় করার এবং নারীরে শাড়ি চুড়ি কিনা দেওয়ার একচ্ছত্র দায় থিকা যেমন উনি মুক্তি পাক, তেমনি একজন নারী নিজের অনিচ্ছাতে সন্তান জন্ম দিয়া সন্তান দেখভাল করার সরলরৈখিক দায় থিকাও নিস্কৃতি পাক। খেয়াল রাখা জরুরী যে, নারীবাদের উদ্দেশ্য সাম্যবাদ বা মানবতাবাদ। কিন্তু সাম্যবাদ যার উদ্দেশ্য, নারীবাদ তার রাস্তা। আপনার ঢাকা টু কুমিল্লা যাওয়ার তরিকা জানা নাই, আপনি যদি লাফ দিয়া মঙ্গল গ্রহে যাইতে চান, তাইলে সেই চাওয়া হাস্যকর হয়।

আমি তাই ফেইসবুকেই নারীবাদ নিয়া কচকচাই। পেশাগতভাবে আমি একজন খুব সাধারণ গবেষক এবং এই গবেষণাতেই আমি আমার সারাজীবন কাটাইতে চাই। এর মাঝখানে যদি মাত্র একজন মানুষরেও আমি পুরুষতান্ত্রিকতা থিকা সরাইয়া আইনা নারীবাদী বানাইতে পারি বা নারীবাদ কারে বলে তা নিয়া এক লাইন ধারণাও দিতে পারি, সেইটাই আমার লাভ। দিন দুনিয়ার সকল সমস্যা আমি একলা সমাধান করতে পারবো না জানি, এবং তা আমার আগ্রহও না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থপর দুই বিঘা পরিসরের বাইরে তাকাইয়া বুঝতে পারেন পৃথিবী এবং মানবসভ্যতা ঠিক রাস্তায় হাঁটতেছে না, তারাই নারীবাদের মজেজা বুঝতে পারবেন। তারাই বুঝতে পারবেন একমাত্র নারীবাদই নারী পুরুষ ইন্টারসেক্স সকল মানুষরে তার লিঙ্গভিত্তিক সরলরৈখিক শ্রমিকসুলভ দায়িত্ব থিকা মুক্তি দিয়া মানুষরে মানুষ হিসাবে তার বৃহত্তর আত্মিক উন্নতির রাস্তা দেখায়। আমি বিশ্বাস করি, নয়টা পাঁচটা চাকরি করা এবং বাচ্চা জন্ম দিয়া গাধার খাটনি খাইটা মইরা যাওয়ার উদ্দেশ্যে মানব জাতি গত ২০০ হাজার বছর ধইরা পৃথিবীতে টিকা থাকে নাই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ একদিন এই পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী লিঙ্গনির্ভর দাসত্ব থিকা মুক্তি পাবেন এবং তখনই হয়তো মানুষ হিসাবে মানুষের উত্তরণ হবে এবং মানুষ হিসাবে মানুষ দিন যাপন করতে পারবেন পৃথিবীতে।

তাই আমারে শুধু ফেইসবুকেই দেখবেন চিল্লাইতে। হাটে মাঠে ঘাটে এই কারণেই আমারে দেখবেন না।

নাদিয়া ইসলাম : নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট ও লেখক