আখতারুজ্জামান আজাদ
বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত বিভিন্ন লেখা পড়তে-পড়তে একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল। ব্যাপারটা মাথা থেকে কোনোভাবেই সরাতে না পেরে সুদূর পটুয়াখালীতে বসে এই গভীর রাতে দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করল। সকালে কুয়াকাটায় সমুদ্রবিলাস করতে যাওয়ার কথা থাকলেও মগজ থেকে সরাতে পারছি না তার বেয়ে নামতে গিয়ে মানুষের পড়ে মরার দৃশ্য। লেখার তাড়না যখন একবার মাথায় ওঠে, তখন সমুদ্রেরও সাধ্য নেই ঐ তাড়নাকে ভাসিয়ে নেওয়ার।

এফআর মানে ফারুক রূপায়ণ। এফআর টাওয়ার রূপায়ণ নামক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকানাধীন। ২০১৫ সালের এপ্রিলের মৃদু ভূমিকম্পে পার্শ্ববর্তী ভবনগুলো অটল-অক্ষত থাকলেও এই এফআর টাওয়ার তার লাগোয়া ভবনের ওপর হেলে পড়েছিল। নিচতলার দেয়ালে ফাটল দেখা দিলে তাও তখন কৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। মালিক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও বিলিয়নিয়ার বলে মূলধারার গণমাধ্যমে তখন খবরটি আসেনি (আজকের ঘটনার পরও ভবনের মালিকের পরিচয় নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন কোনো কথা হচ্ছে না)। রেডিও স্বাধীন নামক একটা পেজে এ সংক্রান্ত একটা ছবি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পোস্টটিকে গায়েব করে দেওয়া হয়। ফেসবুকে এ নিয়ে কিছুটা হৈচৈ হলে ভবনকর্তৃপক্ষ একটি নোটিস সাঁটাতে বাধ্য হয়— এতদ্দ্বারা সর্বসাধারণকে অবগত করা যাচ্ছ যে, বুয়েটের বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ভবনটির সকল প্রকার ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হলো।

তাতে রূপায়ণের বয়েই গেছে। কয়েকদিন পরই ভবনটি পুরোদমে ব্যবহৃত হতে থাকে। মানুষ ভুলে যায় ভবনটি হেলে পড়েছিল, ভবনটিতে ফাটল ধরেছিল, ভবনটি ব্যবহারের অযোগ্য। যে ভবন হেলে পড়ে, ফাটল ধরে, রাজউকের লিখিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যে ভবন দিব্যি ব্যবহৃত হতে থাকে; সে ভবন যে আগুন বা ভূমিকম্প— কোনোকিছু থেকেই নিরাপদ না, সেই ভবনে যে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকবে না— তা তো বলাই বাহুল্য।

চার বছর আগে হেলে পড়া সেই ভবনটিই আজ আগুনে বিধ্বস্ত হলো। রানা প্লাজার মতো ধসে পড়লে মৃত্যুসংখ্যা হয়তো চার অঙ্ক ছুঁত, আগুনে পোড়ায় সংখ্যাটা উনিশ-কুড়ির মধ্যেই সীমিত আছে। এই ভবনে প্রাণহানির ব্যাপারটা অনিবার্যই ছিল। উল্লিখিত তথ্যগুলো অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শামস রাশীদ জয়ের পোস্ট থেকে পেয়েছি। চার বছর আগেই তিনি ভবনটির ব্যাপারে সরব হয়েছিলেন। তার আশঙ্কা আজ ফলে গেল।

রাজউকের নিষেধাজ্ঞার পরও মালিকপক্ষ ভবনটিতে বহাল তবিয়তে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। চালাতে গিয়ে মালিকপক্ষ নিশ্চয়ই একে ম্যানেজ করেছে, ওকে খুশি করেছে, তাকে পুষিয়ে দিয়েছে। রূপায়ণ যাদেরকে ম্যানেজ করেছে, খুশি করেছে, পুষিয়ে দিয়েছে; তারা আপাত অদৃশ্য, তাদেরকে আমরা সাধারণরা চিনি না। না চিনলেও, না জানলেও অন্তত এতটুকু জানি— তারাই রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা বিধাতা, তারাই আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা। চার বছর আগে এই বিধাতারা ম্যানেজড না হয়ে ভবনটার ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে, যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর ছাড়পত্র দিলে হয়তো আজকের এই হত্যাকাণ্ড দেখতে হতো না কিংবা খুন হওয়া মানুষের সংখ্যাটা একটু কম হতো। আজকের ঘটনা নিঃসন্দেহে হত্যাকাণ্ড ছিল। পনেরো তলার অনুমতি নিয়ে এফআর টাওয়ারকে বাইশ তলা পর্যন্ত লম্বা করা হয়েছে, এমনকি এই একই ভবনে আগুন লেগেছিল আট বছর আগেও (প্রথম আলোর তথ্যমতে)। তাই আজকের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড না বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

এফআর-কর্তৃপক্ষ চার বছর আগে কাকে বা কাদেরকে ম্যানেজ করে হেলে পড়া ভবনের কার্যক্রম বহাল রেখেছিল, সরকার তাদেরকে খুঁজে বের করবে কি না; সেটি সরকারের বিষয়, আমাদের মতো আদার ব্যাপারীদের অধিকার নেই এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার। আমাদের অধিকার আছে কেবল আগুনে পুড়ে জীবন্ত বার-বি-কিউ হওয়ার, তার বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে থেঁতলে মরার, তদন্ত কমিটির উপরি উপার্জনের উপকরণ হওয়ার।

হর্তাকর্তা বিধাতারা টেবিলের নিচ দিয়ে যতই ম্যানেজড হন, আমাদের জীবন নিয়ে যতই খেলেন; তাদেরও জেনে রাখা দরকার— আগুন কাউকে চেনে না, আগুন ক্ষমতাধর কিংবা ক্ষমতাহীনকে চেনে না, আগুন সামনে পাওয়া সবাইকেই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সুইস ব্যাংকে কার কয়টা অ্যাকাউন্ট আছে, ঐ ছাই দেখে তা তো বোঝা যায়ই না; খোদ গর্ভধারিণী মাও বুঝতে পারেন না কোন ছাইটুকু তার সন্তানের। সামনের ফাগুনে আগুন ঐ হর্তাকর্তাদেরকেও ছাড় দেবে না। ডিএনএ টেস্টের কবলে পড়ার আগেই আমাদের ভাগ্যবিধাতাদের বোধোদয় হোক।