ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল
জয়ন্ত ঘোষাল
আপনি আর্য? না অনার্য?

আমি ভারতীয়!

বুঝলাম! কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের জানিয়ে আসছে, ভারতীয় মানে আর্য হিন্দু রক্ত। এটাই শেষ কথা। আর্যরা বিদেশি নয়। তারা বাইরে থেকেও আসেনি। রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবার বড় বেশি উদ্বিগ্ন! একদা জার্মানিতে হিটলার আর্য রক্তর বিশুদ্ধতা নিয়ে এ ভাবে রাজনীতি করেছিলেন! সে তো আজ ইতিহাস!

আজ এত বছর পর হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের জিনতত্ত্ববিদ গবেষণা করে ঘোষণা করলেন যে, ডিএনএ পরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতীয়দের উৎস সম্পূর্ণ অন্যত্র! হরপ্পা সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পর জনসমাজে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এ ব্যাপারে গবেষণা চলছে|

রোমিলা থাপারের মতো ঐতিহাসিক চিরকাল বলে এসেছেন, সিন্ধু সভ্যতা প্রাথমিক ভাবে শহুরে এবং শিক্ষিতদের সভ্যতা ছিল! বৈদিক যুগের মানুষ ছিল মূলত কৃষক। বৈদিক মানুষদের কোনও লিপি ছিল না আর তারা শহুরে ছিল না!

এই পরিস্থিতিটি হল পটভূমি!

এ বার বোমা ফাটিয়েছেন পুনে ডেকান কলেজের উপাচার্য এবং পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডে। দীর্ঘ দিন একটি টিম এই এলাকায় গবেষণা চালিয়ে এখন যে সিদ্ধান্তে এসেছেন তাতে সঙ্ঘ পরিবার ক্ষিপ্ত! প্রথম প্রশ্ন, সংস্কৃত ভাষা এবং বৈদিক হিন্দুবাদের উৎস কি হরপ্পা সভ্যতা? জবাব: না! ভারতীয় জনসমাজে কি এখনও হরপ্পা জিন টিকে আছে? জবাব: হ্যাঁ! নিশ্চয়ই! তা হলে ভারতীয়রা আজ বেশি আর্য? না দ্রাবিড়? মানে জনপ্রিয় অর্থে? জবাব: ভারতীয়রা অনেক বেশি দ্রাবিড়! সায়েন্স নামক জার্নালে এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে রাজনৈতিক তোলপাড়!

১৯২০ সালে যখন হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কৃত হয় বিতর্ক তখন থেকে শুরু! ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা বললেন, মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পার পর বৈদিক সভ্যতা এবং তারা এসেছিল বাইরে থেকেই।

ম্যাক্স মুলারের মতো জার্মান ভারততত্ত্ববিদ বলেছিলেন, আর্যরা বাইরে থেকে আসে এবং এখানে এসে তারা সংস্কৃত শেখে! আরএসএস এ কথা মানে না!

হিন্দুত্ব লবি চাইছে, ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা হোক। তারা সিন্ধু সভ্যতাকেও বৈদিক সভ্যতা হিসেবে দেখতে চায়! ৪৫০০ বছরের প্রাচীন রাখিগড়ি এলাকার কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি ভ্রান্ত! আবার এই গবেষণাও কি নির্ভেজাল?

আর্য কারা? আর্য কি কোনও ভাষাগোষ্ঠী? নাকি কোনও জাতি? এই ভাষাগোষ্ঠী বা জাতির আর্যরা কি বিদেশি বা বিদেশি ও ভারতীয়?

ভারতীয় কিছু কিছু লেখক এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, আর্য একটা জাতির নাম। এবং তারা বিদেশি নয়। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা দেখাতে চেয়েছেন যে, অম্বেডকরও বলেছেন আর্যরা বিদেশি নয়।

প্রকৃত সত্য তবে কী? আর অম্বেডকর কোন আর্যদের বিদেশি বলেননি, সে বিষয়ে আমরা আলোকপাত করব।

প্রথমে আমরা দেখি আর্য কারা?

আর্য হচ্ছে একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। আর একাধিক মানবগোষ্ঠীই এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দু’টি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে। আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হল

আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত। এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেমন অসুর নামে পরিচিত, তেমনই নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত।

নর্ডিক আর্য আগমনপূর্ব ভারতীয় আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর ভাষাও ছিল আর্য। এই দিক দিয়ে, অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে এরাও আর্য বলে গণ্য। ঋগ্বেদে এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। অন্য দিকে, নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর বৈদিক ব্রাহ্মণদের ভাষা যেহেতু আর্য ছিল তাই তারা আর্যজাতি হিসাবেই পরিচিত। অতএব, ভাষাগত দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতবর্ষে দু’টি আর্য জাতির সন্ধান মেলে। প্রথমটি হল, আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত প্রাগার্য জাতি এবং অন্যটি হল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত বৈদিক যুগের আর্য জাতি।

অনেক চিন্তাশীল লেখকই ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা বলেন, অম্বেডকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নন। আসলে তাঁরা অম্বেডকরের ব্যাখ্যাকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। আসলে অম্বেডকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষীরা বহিরাগত নয়। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যভাষীরা হলেন বহিরাগত। যদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যাঁরা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত।

‘বেদে আর্যজাতি নামে প্রকৃতপক্ষে কোনও জাতি নেই।’ কারণ, বেদে আর্য শব্দটি কখনওই জাতি অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। তাই বেদে দু’টি মানবগোষ্ঠীর ভাষাকেই আর্য হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। যার একটা হল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর, যা অম্বেডকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে, নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণেরা এবং আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুরেরা যেহেতু আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত, তাই সম্ভবত ব্রাহ্মণেরা অসুরদের ইতিহাস চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে আর্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার দিয়ে দেশীয় অসুরদের অনার্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার করেছেন। আর অসুররা অনার্য মানবগোষ্ঠী হিসেবে প্রচার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই মাটিচাপা পড়ে গেছে আসল সত্যটি যে, ‘দেশীয় অসুররাও প্রকৃতপক্ষে আর্য ভাষাগোষ্ঠীরই মানুষ।’ যদিও উভয়ের মধ্যে, অর্থাৎ আলপাইন ও নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, অসাম্যের পূজারী অত্যাচারী হিটলারের বংশধর নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণেরা তবে কেন নিজেদেরকে আর্য মানবগোষ্ঠী বলে পরিচয় দিলেন? অথচ, একই মানবগোষ্ঠীভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও হিটলারের গোষ্ঠীটি তো আর্যমানবগোষ্ঠী বলে সনাক্ত নয়। তারা তো নর্ডিক মানবগোষ্ঠী বলে পরিচিত। আর ভাষাগোষ্ঠীকে যদি মানবগোষ্ঠী বলা হয় তবে তো মূলনিবাসী আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর ভাষাও তো আর্য ছিল। তারা কেন তবে আর্য মানবগোষ্ঠী বলে গণ্য হলেন না? আর কেনই বা ঋগ্বেদে দেখা যায় নর্ডিক আর্যভাষী এবং আলপাইন আর্যভাষী নামে এই দুই আর্যভাষীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে?

নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেহেতু ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত, তাই তাঁরাই মূলনিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করে ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যু-সহ দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদেরও যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেন। কারণ ইন্দো-ইরানী দাস এবং দস্যু ও দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন অযাজকীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন যাজকীয় মতবাদে বিশ্বাসী। আর জয়ের পরিকল্পনাটি ঠিক এ কারণেই।

কিছু কিছু পশ্চিমী লেখক যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই অনুমান করেছেন যে বৈদিক নর্ডিক আর্যরা দেশীয় দাস এবং দস্যুদের জয় করেছিলেন, যা নিতান্তই ভুল ধারণা। কারণ, দাস এবং দস্যুরা হলেন যেমন দু’টি আলাদা জাতি, তেমনই তারা আবার মূল ভারতীয়ও নয়। তারা ইন্দো-ইরানি এক সম্পদশালী মানবগোষ্ঠী। এখানে পশ্চিমী লেখকরা দাস ও দস্যু নামের অপব্যাখ্যা করে তাদের যেমন মূলনিবাসী বলে চালিয়ে দিয়েছেন, তেমনই মূলনিবাসী আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদের দিয়েছেন মাটিচাপা। এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় যে, সে যুগে ভারতবর্ষ ছিল এক বহুজাতিক দেশ। ঋগ্বেদে তাই অবৈদিক দেশীয় আলপাইন মাববগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যুদেরও অনুপ্রেবেশকারী বৈদিক নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। তাই পশ্চিমী লেখকদের নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণদের জয়ের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে ঋগ্বেদের উদাহরণ দিয়ে অবশ্যই বলতে হত, ইউরোপীয় নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা দেশীয় আলপাইন আর্য অসুর এবং ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যুদের জয় করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু অম্বেডকর বলেছেন, ‘এই দুই আর্য জাতির মধ্যে কারা দাস এবং দস্যুদের জয় করেছিল যদি তারা আদৌ তাদের জয় করে থাকে।’ এ কথার সমর্থনে বলা যায় যে নর্ডিক আর্যরাই দাস এবং দস্যু-সহ মূলনিবাসী আলপাইন আর্যদেরও জয় করেছিল। যার প্রমাণ ঋগ্বেদের উদাহরণ থেকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ঋগ্বেদে দেখা যায়, দাস এবং দস্যুরা আলপাইন আর্যদের পক্ষ নিয়ে নর্ডিক আর্যদের বিরুদ্ধে সর্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আর নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা যে সত্যিই দাস, দস্যু এবং আলপাইন আর্যদের জয় করেছিলেন তা অনুপ্রবেশকারী বৈদিক নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণের নিত্যনতুন বৈদিক আইন প্রণয়ন এবং বৈদিক ধর্মের উপর পরবর্তীকালীন প্রাধান্য থেকেই পরিষ্কার। অতএব, অম্বেডকরের সিদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা বিদেশী ইউরোপিয়ান অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু আলপাইন আর্যরা দেশীয় অসুর জাতি বলেই পরিচিত । যে আলপাইন বা অসুর জাতি নর্ডিক আর্য আগমনের অনেক পূর্বেই নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।  [আনন্দবাজার পত্রিকা]

লেখক: জয়ন্ত ঘোষাল, সিনিয়র সাংবাদিক